বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) একটি গর্বের নাম। কিন্তু আজ সেই কুয়েট এক গভীর অচলাবস্থার মধ্যে নিপতিত। বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম, থমকে গেছে গবেষণা এবং স্থবির হয়ে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। প্রশাসনিক সংকট, ছাত্ররাজনীতি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাস্থা এই অচলাবস্থার মূল উৎস।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে একাডেমিক কার্যক্রম ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও ৪ মে ক্লাস শুরুর ঘোষণা আসে, কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করে কর্মবিরতিতে যান। শিক্ষক সমিতি দাবি করে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে অভিযুক্ত ছাত্রদের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এতে শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
অন্যদিকে, ছাত্রদের একটি অংশ যারা ঘটনাবলিতে সরাসরি জড়িত নয় বা যারা অনুতপ্ত, তারা দুঃখ প্রকাশ করে ক্লাসে ফিরতে চাইলেও, শিক্ষকরা অনড় অবস্থানে রয়েছেন। এ অবস্থায় আমাদের ভাবতে হবে—এই সংকট থেকে আমরা কী শিখছি? এবং সংকটের সমাধানে কার কী ভূমিকা থাকা উচিত?
শিক্ষক শুধু পেশাজীবী নন—তিনি সমাজের আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতিনিধি। শিক্ষক যদি জেদের বশে শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ করেন, তা হলে তার নিজের অবস্থান ও শিক্ষার মূল দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। একজন শিক্ষক যেমন সম্মান পান জ্ঞানের জন্য, তেমনি তিনি সম্মান পান সহিষ্ণুতা, উদারতা এবং বিচারবোধের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বা বিশ্বের যে কোনো মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চর্চায় এমন নজির পাওয়া যাবে না যেখানে শিক্ষকরা সরাসরি ছাত্রদের সাথে ব্যক্তিগত বিরোধে জড়িয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কোনো দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয় বরং সেটি সহমর্মিতার, শেখানো-শেখার, এবং সহানুভূতির।
এ ধরনের অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহানিই ঘটায় না বরং সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষকরা যদি এই সংকটকে অহংকার রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত করেন, তবে শিক্ষা হারায় তার মহত্ব।
শিক্ষকদের মতো প্রশাসনের ভূমিকাও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন যদি কোনো রাজনৈতিক চাপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অমান্য করে, তবে সেটি শিক্ষকদের ক্ষুব্ধ করার যথেষ্ট কারণ। তবে প্রশাসনিক ভুলের প্রতিকারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষা কার্যক্রমকে জিম্মি করে রাখাও কোনো সভ্য সমাধান নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ছিল অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি গঠন করে, সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেই ব্যর্থতা আজ এক মারাত্মক আস্থার সংকটে পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা—যারা কোনো ঘটনায় জড়িত নয়, কিন্তু একাধিক পক্ষের জেদের বলি হয়ে তাদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে ক্যারিয়ার প্রস্তুতি, উচ্চশিক্ষার আবেদন কিংবা চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, যাদের জীবন থমকে দাঁড়িয়েছে।
কেউ ভুল করলে তার শাস্তি হওয়া উচিত; কিন্তু যারা ক্ষমা চায় এবং নিজেদের সংশোধন করতে চায়, তাদের প্রত্যাখ্যান করা কি ন্যায়বিচার? যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমা, সংশোধন ও সংলাপের জায়গা না থাকে, তাহলে শিক্ষা কীভাবে মানবিকতার চর্চা হবে?
শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে সমাজের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধেয় পেশার প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন। কিন্তু এভাবে যখন তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আবেগ উপেক্ষা করে কর্মবিরতি চালিয়ে যান, তখন তা তাদের প্রতি সমাজের সহানুভূতিকে ক্রমশ ক্ষয় করে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে—এভাবে চলতে থাকলে কি শিক্ষকদের প্রতি অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের বিরক্তি বাড়বে না? শিক্ষকরা যদি অসংবেদনশীল ও অনমনীয় অবস্থান নেন, তবে তারা শিক্ষাব্যবস্থার ভরসাস্থল থেকে বিচ্যুত হবেন, যা জাতির জন্য ক্ষতিকর।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখন প্রয়োজন সকল পক্ষের মধ্যকার আস্থা পুনর্গঠন। প্রথমত, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা হোক। দ্বিতীয়ত, ক্ষমাপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে এনে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হোক।তৃতীয়ত, শিক্ষকরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করুন রাজনৈতিকভাবে নয়, বরং নৈতিক শক্তিতে ও গণতান্ত্রিক কণ্ঠে। চতুর্থত, ভবিষ্যতের জন্য এমন সংকট মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন যেখানে শিক্ষক, প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও আচরণবিধি নির্ধারণ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই আরও স্বচ্ছ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং অংশগ্রহণমূলক হতে হবে।আর ছাত্র রাজনীতি যদি নৈরাজ্য বা সহিংসতার রূপ নেয়, তবে সেটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
শিক্ষা শুধু পঠনপাঠনের বিষয় নয়, এটি মানবিকতা, নেতৃত্ব এবং বিবেচনার একটি অনুশীলন। কুয়েটের সংকট আমাদের একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে নিজেদের ভুল শুধরে একটি ভবিষ্যত-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার।
চলমান পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, সমঝোতার পথে হাঁটলে সংকট নিরসন সম্ভব। প্রতিশোধ, জেদ, কিংবা প্রতিপক্ষ বানিয়ে রাখার চেয়ে আলোচনায় বসা, সহমর্মিতা দেখানো এবং সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণই পারে কুয়েটকে আবার তার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয় আবার প্রাণ ফিরে পাক, শ্রেণিকক্ষে ফিরুক আলো, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হোক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার বন্ধনে-এই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। Email: amm203@gmail.com
খুলনা গেজেট/এনএম